১২০৪ মিনিট আগের আপডেট; রাত ২:৪৭; বৃহস্পতিবার ; ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সেরার মুকুটে সোনালি পালক

আমার কক্সবাজার ডেস্ক: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:৫৩

ইতিহাস দরজা খুলেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়। একটু একটু করে সে অপেক্ষা ফুরাচ্ছিলও। ৬৭ মিনিট পর্যন্ত যখন গোলে কোনো শটই নিতে পারেনি ফ্রান্স, আর আর্জেন্টিনাও এগিয়ে ২-০ গোলে, তখন সর্বকালের সেরা হিসেবে লিওনেল মেসির মুকুটে শেষ পালক যুক্ত হওয়াকে ভবিতব্য বলে ধরে নেওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কত কিছুই তো জিতেছেন, ছুঁয়ে দেখা বাকি ছিল কেবল বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটাই। মুকুটের সজ্জায় এই সোনালি পালকটি যোগ না হলে নিজের শেষ বিশ্বকাপ থেকে অপূর্ণতা নিয়েই ফিরতেন।

নির্ধারিত সময়ের খেলার ১২ মিনিট বাকি থাকতেও আর্জেন্টাইন জাদুকরের ‘সম্পূর্ণ’ হওয়ার সম্ভাবনায় কারো আস্থা হারানোর কোনো কারণ ছিল না। একটু একটু করে তিনি ট্রফি নিতে পোডিয়ামের দিকে এগোনোর আগাম ছবিই ফুটিয়ে তুলছিলেন বিশ্বজুড়ে তাঁর ভক্তদের মানসপটে। লুসাইল স্টেডিয়ামের একপেশে ফাইনালে ফরাসিদের উড়িয়ে দিয়ে দুই রকম অর্জনের ক্ষণগণনাও শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান, সেই সঙ্গে মেসিরও বিশ্বকাপ ট্রফি আলিঙ্গন, দুয়ে মিলে আনন্দাশ্রুতে একাকার হওয়ার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল।

 

কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালের যে তখনো এর নাটকীয়তা আর রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চের ডানা মেলা বাকি। একতরফা ফাইনালের রং মুহূর্তেই ভোজবাজির মতো বদলে গেল। নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে থাকা কিলিয়ান এমবাপ্পে ৯৭ সেকেন্ডের জাদুতে আর্জেন্টিনার সাজানো বাগানে লুটতরাজ চালালেন। পেনাল্টি থেকে গোল করলেন প্রথমে, এর রেশ কাটতে না কাটতেই দারুণ এক ভলিতে আর্জেন্টিনার ঘনিয়ে আসতে থাকা উৎসব ভণ্ডুল করে দ্বিতীয়টিও।

২-২ গোলের সমতায় ফিরল ফাইনাল, উজ্জীবিত ফরাসিরাই বরং তখন পাল্টা চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা করতে থাকল আলবিসেলেস্তেদের। পেনাল্টি থেকে নিজে গোল করে এবং আনহেল দি মারিয়ার গোলে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে আসা অধরা সোনালি ট্রফিটাও যেন মেসির কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকল একটু একটু করে। ২০১৪-র মতো করেই যেন মনে হতে থাকল, ‘এত কাছে তবু কত দূর!’

অতিরিক্ত সময়ের খেলায়ও বিশ্বকাপ ট্রফির সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকল তার। নিজে গোল করলেন আরেকটি, মনে হতে থাকল এই ট্রফি ছুঁলেন বলে! কিন্তু আবার মেসি আর ট্রফির মাঝে দেয়াল তুলে দাঁড়ান এমবাপ্পে। ফিরিয়ে আনেন ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করা ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টকে। ইতিহাসে তাঁর সঙ্গী হয়ে যাওয়া এই ফরাসি তারকা নিজেও পেলের পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে ২৪ বছরের কম বয়সে টানা দুটি বিশ্বকাপ জেতার দাবি ছাড়েন না। ফাইনালে প্যারিস সেন্ট জার্মেইর এই দুই খেলোয়াড় আবার সমানে-সমান। হ্যাটট্রিকে অনন্য হয়ে ওঠা এমবাপ্পে দ্বিতীয় পেনাল্টি থেকেও লক্ষ্যভেদে ভুল করেন না।

ফাইনাল তাই গিয়ে ঠেকে সত্যিকারের ভাগ্য পরীক্ষায়। টাইব্রেকার যখন, যে কারো হৃদয়ভঙ্গের চোখরাঙানি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সেরার মুকুটে শেষ পালকটি যোগ করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়তে হয় মেসিকেও। ট্রফি নিশ্চিত করতে এমিলিয়ানো মার্তিনেসে ভর দিয়ে ফিরতে হয় ১৯৯০-র সের্হিও গয়কোচিয়াকেও। সেবার ডিয়েগো ম্যারাডোনার দলের গোলরক্ষকের শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপটি আর জেতা হয় না। কিন্তু মার্তিনেস সেই দুর্ভাগ্যে আর পুড়তে দেন না মেসিকে। ফ্রান্সের হয়ে কিংসলে কোমানের নেওয়া দ্বিতীয় শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দেন। স্নায়ুক্ষয়ী টাইব্রেকারে ফ্রান্সও যেন তাতে ভেঙে পড়ে কিছুটা।

তৃতীয় শটে চুয়ামেনি তাই বাইরে মেরে বসেন। নির্ধারিত সময়ের ৭৮ মিনিট পর্যন্ত দৃশ্যমান থেকে মিলিয়ে যেতে থাকা ট্রফিটাও আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেসির। এবার আর ধুক করে বুক কাঁপিয়ে তোলার মতো কিছু হতে দিলেন না গনসালো মন্তিয়েল। টাইব্রেকারে চতুর্থ শটে লক্ষ্যভেদ করেই দিলেন স্বপ্নপূরণের দৌড়। ভারমুক্ত হয় আর্জেন্টিনা, সেই সঙ্গে মেসিও।

অমরত্বের পেয়ালায় কত আগেই তো চুমুক দিয়ে ফেলেছিলেন এই খুঁদে জাদুকর। প্রভাববিস্তারি ফুটবল খেলার স্থায়িত্বে এমনকি ম্যারাডোনাকেও পেছনে ফেলে দিয়েছেন বলে একমত সিংহভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞই। কিন্তু সোনালি ট্রফিটাই কেবল তাঁর ছিল না। সেটির জন্য কতটা কাতর ছিলেন, গোল্ডেন বল নিয়ে পোডিয়াম থেকে নেমে যাওয়ার পথে তা স্পষ্ট হলো আরেকবার। সোনালি ট্রফিতে চুমু খাওয়ার তর যেন তাঁর সইছিলই না! সেটি নিতে সদলবলে আবার মঞ্চে ওঠার আগেই খুব একচোট চুমু খেয়ে নিলেন তখনই।

সর্বকালের সেরার মুকুটে সোনালি পালকের সজ্জায় পরিপূর্ণ মেসি!