৯৭৬ মিনিট আগের আপডেট; দিন ১১:০০; শুক্রবার ; ২৮ মার্চ ২০২৪

সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও সাম্প্রদায়িকতা

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:৩৪

আমাদের দেশের প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতির নানা অপশক্তি নানাভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। কেউ কেউ ঢাহা মিথ্যার বেসাতি করে বেড়ায়। কেউ কেউ গুজব ছড়ায়। একাধিক অপশক্তি আছে যারা ধর্মীয় আবেগ, বিশ্বাস আর ভাবাদর্শকে সাধারণ মানুষের ভোটে ব্যবহার করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। খুব নিকট অতীতেই আমরা দেখেছি, এ ধরনের অপপ্রচারে এমনকি বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারাও অংশ নিয়েছিলেন। 

আমরা এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছিলাম গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটাতে। কিন্তু নির্বাচনে গণতন্ত্রের করণীয় দলিল তিন জোটের রূপরেখার প্রতিশ্রুতি ছেড়ে ভোট প্রাপ্তির জন্য বড় একটি দল এবং তার সহযোগী অন্যরা ধর্মীয় ইস্যু সামনে নিয়ে এলো। আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে দেশে ধর্ম থাকবে না, মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, ভারত বাংলাদেশ দখল করে নেবে, বাংলাদেশ ভারতের গোলাম ও তাঁবেদার হয়ে যাবে—এ ধরনের সস্তা, আজগুবি এবং ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন বক্তব্য ছড়িয়ে দেশের বৃহত্তর ভোটারদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করেছিল। এমনিতেই স্বাধীনতার পর থেকে গোপনে এই বিষয়গুলো প্রচার-প্রচারণায় অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল এবং পত্রপত্রিকায় অনেকেই মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য নানা আজগুবি, বিকৃত তথ্য ও লেখালেখি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিল।

১৯৭৫ সালের পর থেকে সেই অপপ্রচার আর গোপন থাকেনি। রাজনীতি, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নানা নীতি-কৌশলে এর ব্যাপক প্রয়োগ ঘটানো হয়েছিল। মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিজনদের সম্পর্কে নানা মিথ্যা অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর থেকে সমাজ, রাজনীতি আর জনমানসে অপপ্রচারকারীরা বাধাহীনভাবে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির অপপ্রচার আর অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কুৎসা, লুটপাটের বানোয়াট কেচ্ছাকাহিনি প্রায় দুই দশক ধরে প্রচার করে এসেছিল।  বাংলাদেশের নির্বাচনের রাজনীতির ভাগ্যে এই প্রবণতার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

১৯৯৬-এর নির্বাচনেও গুজব, অপপ্রচার কম ছড়ানো হয়নি। ২০০১-এর নির্বাচনেও একই পরিস্থিতি, একই প্রচার-অপপ্রচার বাধাহীনভাবে চলেছিল। তবে ২০০৮-এর নির্বাচনে সেই সব অপশক্তির প্রচার-প্রচারণা সাধারণ মানুষ কানে নেয়নি। তত দিনে মানুষের এক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০৯-১০ সালের পর ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় এবং ভারতীয় নানা বিষয় নিয়ে প্রচার-অপপ্রচার চারদিকে সয়লাব হতে থাকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত গুজবের সত্য-মিথ্যা যাচাই করার ক্ষেত্রে অনেকেরই অভিজ্ঞতা তখন হয়নি। অনেকেই সে কারণে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। নানা উত্তেজনা ছড়িয়ে বিগত দিনগুলোতে অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নামে নানা মিথ্যাচার অনেক নিরীহ মানুষের নামে ছড়ানো হয়েছে। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেককেই নির্যাতন, অত্যাচার, বাড়িঘর ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কল্পিত গুজব, চরিত্র হনন, মিথ্যাচার ছড়ানো, বিভেদ, বিদ্বেষ দেশ-বিদেশ থেকে একের পর এক ছড়ানো হচ্ছে। এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে প্রতিদিন মিথ্যা ট্রল করা হচ্ছে না। গোটা সমাজ যেন এ ধরনের অপপ্রচারে ডুবে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।

করোনাকালে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোয় অপপ্রচার যেমন ছড়ানো হয়েছে, আবার ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাওয়ার কল্পিত কাহিনিও ছড়ানো হয়েছে—বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা নেই, অচিরেই বাংলাদেশ অর্থশূন্য হয়ে পড়বে, গ্যাস থাকবে না, কয়লাবিদ্যুৎ থাকবে না, দেশের সব টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। হালে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা খুশি তা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে তো নানা ধরনের গুজব, কল্পকাহিনি ছড়ানো হচ্ছেই।

বাংলাদেশে গত ১৪ বছর যেন কোনো উন্নয়ন হয়নি, সবই সরকারের মিথ্যাচার, অপপ্রচার বলে বিদেশে বসে বসে অনেকেই ‘বিশেষজ্ঞ মত’ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চূড়ান্ত চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। আমাদের দেশে গোয়েবলসের বহু প্রেতাত্মা ১৯৪৭ সালের পর থেকে বংশ বিস্তার করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা আবার ডানা মেলে উড়তে শুরু করেছে। পরবর্তী সময়ে তাদের বংশধররা মুখে মুখে গুজব, অপপ্রচার রাজনীতি এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় ছড়িয়ে বেড়িয়েছে। 

এখন তাদের প্রধান আশ্রয়-অবলম্বন হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। এরা এখন আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ইস্যুতে বানোয়াট সব খবর ছড়িয়ে বেড়াতে শুরু করেছে। তাতে বাদ যায় না ব্যক্তিগত বিষয়াদি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিভিন্ন বাহিনী, দেশের চিন্তাশীল মানুষদের নিয়েও নানা বিষয়ে উত্তেজনাকর গুজব ছড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ইউজারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ এখন তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে।

আগামী নির্বাচনে যেন এই তরুণরা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে চিন্তা করতে না পারে সেই বিষয়গুলো বেছে বেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে বিভিন্ন পেশাজীবী নারী-পুরুষদেরও নানা বিষয় সামনে তুলে আনতে তারা রাত-দিন কাজ করে বেড়াচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে গুজব, মিথ্যা ছড়ানোর নানা কনটেন্ট নিয়ে বসে আছে হাজার হাজার কনটেন্ট ক্রিয়েটর। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, তত এদের মগজ থেকে নতুন নতুন কনটেন্ট সৃষ্টি হবে, যা দেখে ও শুনে অনেকেই বিভ্রান্ত হতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এদের বিপক্ষে সামাজিক গণমাধ্যমে যথার্থ তথ্য-উপাত্ত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হওয়ার মতো পর্যাপ্ত ক্রিয়েটরকে দেখা যাচ্ছে না।

দেশে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরো অনেক অপশক্তিকে মাঠে সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীদের তো বেশ আগে থেকেই সক্রিয় হতে দেখা গেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের ওপর যে হামলা, বাড়িঘর লুটপাট, নারী ধর্ষণ, নির্যাতন এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছিল, তা ছিল নজিরবিহীন।

ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত জামায়াত-বিএনপির জোট সরকার পাঁচ বছর দেশে যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা ওই সময়ের পত্রপত্রিকায় ছবি ও সংবাদ হয়ে এখন চাপা পড়ে আছে। ৩০ বছরের নিচে যাদের বয়স তারা এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। ফলে এখন আবার সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই নয়, সামাজিকভাবে ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা, দেবদেবীর প্রতিমা ভাঙচুর ইত্যাদি বিষয়কেও পুনরুজ্জীবিত করা হলে এর পূর্বাপর ইতিহাস তরুণ-যুবকদের অনেকেরই বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা অস্পষ্টতা থাকতেই পারে। কিন্তু এটি যে রাজনীতিতে সাত-আট দশক ধরে ব্যবহার করে আসা অপশক্তিরই কাজ, সেটি তাদের অনেকেই বুঝতে সক্ষম না-ও হতে পারে।

সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি আমাদের সমাজ ও রাজনীতির গভীরে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে আছে। জমি দখল, সম্পদ দখল এবং রাজনীতিতে কর্তৃত্ব লাভের অনুষঙ্গ হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি একাধিক মহল নানাভাবে ব্যবহার করে আসছে। নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের চাপ প্রয়োগের জন্যই এখন থেকে প্রতিমা ভাঙাভাঙির বিষয়টি শুরু করা হয়েছে কি না তা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোকে ভেবে দেখতেই হবে। এমনিতেই বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক আদর্শের একটি ভয়াবহ অবনমন ঘটার সময় এখন আমরা অতিক্রম করছি। 

সাম্প্রদায়িক মানসিকতা আমাদের এই সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে অনেকটাই নির্বিঘ্নে প্রসারিত হচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষা-সংস্কৃতির ও বিজ্ঞানশিক্ষার অভাবে অনেক তরুণই এই অপশক্তির খপ্পরে পড়ছে। এরাই এখন হিজরতের নামে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে এদের ব্যবহার করারও প্রস্তুতি চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অপশক্তিকে রোধ করার জন্য অসাম্প্রদায়িক শক্তি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলো কতটা প্রস্তুতি নিচ্ছে? গণতন্ত্র তো এদের থাবার নিচে অনেক আগেই পড়ে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র আসবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়?

https://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2023/02/10/1246596

লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফেলো ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়