৬৪ মিনিট আগের আপডেট; দিন ১২:২২; শুক্রবার ; ১৮ এপ্রিল ২০২৪

আমাদের ক্ষমা করবেন প্রিয় ইলিয়াস কাঞ্চন

মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৫৬

ভালো কাজ করলে বাংলাদেশে যে অন্তত সেটার প্রতিদান পাওয়া যায় না, বরং কিছু মানুষের চক্ষুশূলে পরিণত হতে হয়, সেটা আরও একবার প্রমাণীত হলো। নিরাপদ সড়কের দাবীতে ঘরের খেহে বনের মোষ তাড়িয়ে নিঃস্বার্থভাবে আন্দোলন করে যাওয়া একটা মানুষকে নিয়ে যেসব নোংরামি আজ চোখে পড়লো, সেগুলো দেখে হতভম্ভ হয়ে গেছি।

হ্যাঁ, নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের কথা বলছি, গত ছাব্বিশ বছর ধরে যিনি 'নিরাপদ সড়ক চাই' বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন, বিনিময়ে যার ঘরে একটি পয়সাও যায়নি, বরং আন্দোলনটা তাকে চালাতে হয়েছে নিজের পয়সার, সেই মানুষটাকে দলবেঁধে আক্রমণ করেছে একপাল হায়েনা। কাঞ্চনের ছবি নিয়ে প্ল্যাকার্ড-ব্যানার বানিয়েছে তারা, সেখানে পরিয়েছে জুতার মালা! 

পরিবহন শ্রমিক আর মালিকদের কাছে 'ইলিয়াস কাঞ্চন' নামটা চক্ষুশূল হয়ে আছে অনেক বছর ধরেই। বিভিন্ন সময়ে তাকে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছে এসব সংস্থার লোকজন। রাজপথে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে, তার ছবি পোড়ানো হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের বিভিন্ন সমাবেশ থেকে তার ওপরে হামলা চালানোর উস্কানিও দেয়া হয়েছিল নানা সময়ে, এমনকি তার গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে তাকে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দেয়া হয়েছে। 

ইলিয়াস কাঞ্চনের 'অপরাধ' একটাই, তিনি পরিবহন শ্রমিক আইনের সংশোধন চেয়েছেন, নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় নেমেছেন, চালক-যাত্রী-পথচারী সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুর পর থেকেই নিরাপদ সড়কের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, আর কেউ যায়ে চালকের অসাবধানতায় মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়ে, কোন মানুষকে যেন তার মতো সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে না হয়, সেজন্যেই নিজের ক্যারিয়ারকে একপাশে ফেলে রেখে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা। 

নিজের ব্যস্ত শিডিউল, চাকরি, শুটিং, তারকাখ্যাতি- সবকিছু সামলে নিয়মিত রাস্তায় ছুটে গেছেন কাঞ্চন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। চালকদের বুঝিয়েছেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি না চালানোর অনুরোধ করেছেন। যাত্রীদের বলেছেন সড়ক আইনের কথা, পথচারী পারাপারের নিয়মের কথা। নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে সংগঠন চালিয়েছেন, অফিসের ভাড়া দিয়েছেন, লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করেছেন সেগুলো। অনেকেই তাকে নিয়ে হেসেছে, মশকরা করেছে, ইলিয়াস কাঞ্চন তাতে দমে যাননি একটুও, নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেছেন বারবার। 

একটা সময়ে পরিবহন শ্রমিকেরা তাকে শত্রু ভাবতে শুরু করেছে, মালিকপক্ষ তাদের বুঝিয়েছে, এই ইলিয়াস কাঞ্চন লোকটা ড্রাইভার-হেল্পারদের বিচার চায়, তারা তাই কাঞ্চনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রও করা হয়েছে, উড়ো ফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে মেরে ফেলার।

কাঞ্চন সেসবে ভয় পাননি, আন্দোলন থামানোর কথা মাথায় আনেননি। যতোবার হুমকি এসেছে, কাঞ্চনের চোখে ভেসে উঠেছে তার স্ত্রী জাহানারার রক্তে ভেসে যাওয়া দেহটার ছবি। প্রিয়জন হারানোর এমন পরিণতি যেন আর কারো ভাগ্যে না জোটে, সেই মিশনে আরও জোর কদমে চলতে শুরু করেছেন তিনি।

কিন্ত দিনশেষে কাঞ্চনের সেই কাজগুলোর মূল্যায়ন হয়েছে খুব কম। এত ঝড়-ঝাপটার পরে আজ যখন সড়ক আইন বাস্তবায়ন হয়েছে, তখন পরিবহন ব্যবসার ফ্র‍্যাংকেনস্টাইনেরা জনগনের টুঁটি চেপে ধরতে চাইছে, গাড়ি বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে জিম্মি করতে চাইছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাদের দিতে হবে, মানুষ মারার অধিকার তারা চায়! আর তাই গাড়ি বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়েও নোংরামী শুরু করেছে পরিবহন শ্রমিকেরা। 

কাঞ্চনের ছবি নিয়ে ব্যানার বানিয়ে টানিয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন স্থানে, সেই ছবির সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে ঝাড়ু আর জুতা। ব্যানারে লেখা হয়েছে কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা। অবশ্য, খুনিদের মুখের ভাষা তো আর সুন্দর কিছু হবে না। ইলিয়াস কাঞ্চমের গালে গালে জুতার বাড়ি মারতে চেয়েছে তারা, কারণ তাদের মানুষ খুনের বিরুদ্ধে কাঞ্চনই সবার আগে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, সড়ক আইন নিয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন, লাইসেন্স এবং ফিটনেস টেস্ট ছাড়া যাতে একটা গাড়িও রাস্তায় নামতে না পারে, এই দাবী বারবার তুলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। সেজন্যেই আজ তাকে নিয়ে এই নোংরামিগুলো করা হচ্ছে।

অথচ ইলিয়াস কাঞ্চন কখনও সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে একতরফা ভাবে চালকদের দায়ী করেননি। তিনি সচেতন করেছেন পথচারীদের, বলেছেন, গাড়ির মালিককেও দৃষ্টি রাখতে হবে গাড়ির ফিটনেসের দিকে, দায় আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও, লাইসেন্স ছাড়া যাতে কেউ গাড়ি চালাতে না পারে সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের। অথচ মাথামোটা কিছু মানুষকে ভুলভাল বুঝিয়ে কাঞ্চনের বিরুদ্ধে মাঠে নামানো হয়েছে, কারা এসব করছে সেটাও আমরা জানি। ইলিয়াস কাঞ্চনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কারা তৃপ্তিতে ভোগে, সেটা বুঝে নিতে তো কষ্ট হয় না।

এই দেশ আসলে ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো কাউকে ডিজার্ভ করে না, এই দেশ ভালো মানুষের জন্যে না। প্রিয় ইলিয়াস কাঞ্চন, আপনি আমাদের জন্যে অনেক করেছেন, কিন্ত আপনাকে প্রাপ্য সম্মানটা আমরা দিতে পারিনি, বরং অসম্মানটাই বেশি উপহার পেয়েছেন আপনি। যদি সম্ভব হয়, আমাদের ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ...