১০০৬ মিনিট আগের আপডেট; দিন ১১:৩১; শুক্রবার ; ২৮ মার্চ ২০২৪

একজন ক্ষণজন্মা শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান

তানভীর মোর্শেদ তামীম ২২ মে ২০২০, ১৩:১৭

কবি - সাহিত্যিক - লেখক - গবেষক  হলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের চেতনার জলন্ত প্রদীপ। তাঁদের চেতনায় থাকে সত্য- সুন্দরের ঐকতান স্রোত। তাঁদের ধ্যান- ধারণায় আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে ভূয়সী  দর্শন। আর সে দর্শনের উপর ভিত্তি করে রচিত হয় কোন দেশ কিংবা জাতির গৌরবগাঁথা।

এরা ক্ষণজন্মা। এরা বারবার জন্মায় না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ,  দ্রোহ এবং প্রেমের কবি নজরুল কিংবা চিত্ররূপময়ী কবি জীবনানন্দ দাশ এই অপরূপ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন আজ বহুবছর। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর এত বছর পরও কি আমরা এই বঙ্গদেশে একজন নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাশকে পেয়েছি? পায়নি!  আর কখনো পাবোও না। কারণ এরা বারবার জন্মায় না। এরা একবারই জন্মায় আর একবারই মৃত্যুবরণ করে রেখে যায় লক্ষ কোটি মানুষের কাছে তাঁদের চেতনা - দর্শন এবং জীবনবোধ। আর সে বোধের আলোতে আলোকিত হয় অন্ধকার পৃথিবী ।

সে রকমই একজন ক্ষণজন্মা, পণ্ডিত, গবেষক, লেখক শিক্ষাবিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সহজ- সরল জীবন যাপন ছিল তাঁর জীবনবোধের অন্যতম ছাপ। তিনি কোন সীমা কিংবা গণ্ডির ভেতর নিজস্ব চিন্তা- চেতনাকে বন্দি করে রাখার পক্ষে ছিলেন না। তিনি মুক্ত চিন্তা এবং মুক্ত স্বাধীনতার পক্ষের একজন আদর্শিক লোক।

ছাত্রজীবন থেকে জড়িত ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে। তার ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। 

আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিনী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। তাঁর বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। সেদিক বিবেচনা করলে লেখালেখির চর্চা তাঁর রক্তে বহু আগে থেকে বর্তমান ছিল। তার শিক্ষাজীবন এবং কর্মজীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুলে। 

এখানে তিনি তৃতীয় - সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর  চলে এসেছিলেন পূর্ব বাংলায়।  ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন আরম্ভ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালের জুনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। যুদ্ধকালীন সময় গঠিত অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। এরপর বেশ কিছু বছর তিনি বিদেশে ছিলেন। সেখানে গবেষণা এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের হয়ে নিয়োজিত ছিলেন ।

১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন।  এছাড়াও তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতার সহিত।

তবে লেখক এবং গবেষক আনিসুজ্জামান যে দিকটাই নিজেকে ছাড়িয়ে এপার-ওপার বাংলায় গণ মানুষ এবং সাহিত্য সাধনার উজ্জ্বল বাতিঘরদের মধ্যে স্থান পেয়েছিলেন সে দিকটা ছিল তার লেখালেখি এবং বাংলা সাহিত্যের উপর গবেষণা। আর তার ধারাবাহিকতায় তিনি শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়।

এছাড়া তিনি ১৯৯৩ ও ২০১৭ সালে দুইবার আনন্দবাজার পত্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত আনন্দ পুরস্কার, ২০০৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট. ডিগ্রি এবং ২০১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগত্তারিণী পদক লাভ করেন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়।

অবশেষে আরো একটি নক্ষত্রের পতন! ২০২০ সালের ১৪ মে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারিয়ে ফেললাম একজন ক্ষণজন্মা শিক্ষাবিদ এবং গবেষক। এ ক্ষতি নিঃসন্দেহে অপূরণীয়। তবুও তাকে নিয়ে এ বাংলায় বেশ কিছু সমালোচনা আছে এবং তা আজীবন থাকবে। তবে সে সব সমালোচনা তাঁর কীর্তির কাছে যৎসামান্যের চেয়ে সামান্য ঠেকবে, এমনটা আমার বিশ্বাস। 

 

লেখক :

তানভীর মোর্শেদ তামীম

 কলামিস্ট।