৯৩৪ মিনিট আগের আপডেট; রাত ২:৪১; বৃহস্পতিবার ; ২৭ মার্চ ২০২৪

করোনার প্রাদুর্ভাব: জীবন না জীবিকা-কোনটা আগে?

তাছলিমা হোসেন শিখা ০১ জুন ২০২০, ১৪:৪৩

করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার রোধে টানা ৬৬ দিন সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির পর ৩১ মে থেকে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও গণপরিবহনের অর্ধেক আসন খালি রাখার শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার।

গণপরিবহন মালিকদের দাবির মুখে ৬০ শতাংশ ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন অজুহাতে ভাড়া বাড়ালেও সরকারের দেওয়া শর্ত মেনে চলেননি গণপরিবহন মালিকরা।

তবে চিন্তার বিষয় এই যে করোনার ঝুঁকি নিয়ে গণপরিবহন সীমিত আকারে চললেও অফিসগামী মানুষ তো আর সীমিতভাবে বের হবেন না। চাকরি রক্ষার্থে তাদের বাড়ির বাইরে বের হতেই হবে। ফলে যাত্রীরা বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে গণপরিবহনে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। মনিটরিং করা হবে বলা হলেও এটা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

আর এর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর মাত্রা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে বাইরে থেকে করোনা ভাইরাস খুব সহজে অফিসে ঢুকবে এবং অফিস থেকে বাড়িতে প্রবেশ করবে। এভাবে চললে কীভাবে বয়স্ক, অসুস্থ, গর্ভবতী আর শিশুদের এই মহামারি থেকে রক্ষা করা যাবে সেটা এখন বড়ো প্রশ্ন।

যেখানে জাতীয় পরামর্শক কমিটি জুনের তিন সপ্তাহ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পরামর্শ দিয়েছিল, সেখানে সরকারের সব কিছু খুলে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত আমার কাছে আত্মঘাতী মনে হচ্ছে। কমিটি বলেছে, দেশ এখনও সংক্রমণের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেনি। বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশে করোনার ঝুঁকি আরও বাড়বে।

প্রয়োজনে সরকারকে কারফিউ জারি করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কিন্তু কারফিউ তো দূরের কথা, সবকিছু ‘খোল যা সিম সিমে’র মতো মনে হচ্ছে। করোনা সংক্রমণের উর্ধ্বগতির এই সময়ে মানুষ আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করলে দেশের অবস্থা যে কী হবে- তা বিশেষজ্ঞদের নানা ভবিষ্যৎবাণী থেকে সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঘোষণা অনুযায়ী এখনও সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে পুরো দেশ। ৩১ মে পর্যন্ত দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ১৫৩ জন। আর মৃতের সংখ্যা ৬৫০। একদিনেই ৪০ জন মারা যাওয়া রেকর্ড হয়েছে। আর উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিনই তো মানুষ মরছে। সাম্প্রতিককালে প্রতিদিনই দুই হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। জলজ্যান্ত মানুষগুলো এখন সংখ্যায় পরিণত হচ্ছেন। তাই সবকিছু খুলে দেওয়ার পর পরীক্ষার হার বাড়ানো হলে আরও বেশিসংখ্যক মানুষ যে আক্রান্ত হবেন তা বলাই বাহুল্য।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আমরা কী ভ্যাকসিনবিহীন হার্ড ইমিউনিটির পথে চলা শুরু করছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন আবিস্কারের আগে প্রাকৃতিকভাবে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হবে, আর যত মানুষ মারা যাবে তার সংখ্যা হবে বিশাল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, করোনা ভাইরাসে হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে ৯০ ভাগ মানুষকে সংক্রমিত হতে হবে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনে ৯ জন আক্রান্ত হতে হবে।

সে হিসাবে ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি হতে হলে ১৬ কোটি মানুষের করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। আসলেই পরিস্থিতি যদি জটিল আকার ধারণ করে তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা কীভাবে সামাল দেবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

এদিকে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে চলছে আরেক তেলেসমাতি কারবার। সাধারণ মানুষের করোনা পরীক্ষা করানো রীতিমতো দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে করোনা ভাইরাস উপসর্গ নিয়ে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অন্য রোগে বিনাচিকিৎসায় মারা যাওয়ার সংখ্যাও কম না।

কারণ হাসপাতালগুলোতে করোনা নেগেটিভের সার্টিফিকেট না দেখালে অন্য রোগীদের ভর্তি নিচ্ছে না। তাই কেউ অসুস্থ হলে, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়লে করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। কিন্তু ধরাধরি করে পরীক্ষা করার সুযোগ পেলেও কোন কোন ক্ষেত্রে রিপোর্ট এক মাসেও পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

বহির্বিশ্বের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় জারি করা লকডাউন শিথিল করার পর অনেক দেশ বিপদে পড়েছে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, পেরু, ভারত, পাকিস্তানসহ বেশকিছু দেশে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিশ্ব তালিকায় নয় নম্বরে উঠে এসেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, বিশ্ব থেকে করোনা ভাইরাস এত তাড়াতাড়ি বিদায় নেবে না। মানুষ যেভাবে স্বাভাবিকভাবে চলাচল বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে আরেক দফা এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জন্য বিশ্বকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

লকডাউন ও বিধিনিষেধ শিথিল করায় সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে চীন, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, ইরান আবার কঠোর ব্যবস্থা জারি করছে। তাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি লেজেগোবরে হয়ে গেলে এবার হয়তো দেশে কারফিউ জারি করতে হতে পারে। কারণ বেঁচে থাকলে না জীবিকার প্রয়োজন হয়। জীবনই যদি না থাকে জীবিকা দিয়ে কী হবে?  (সূত্র: প্রথম আলো, বিডিনিউজ, সমকাল, বিবিসি বাংলা)

লেখক

তাছলিমা হোসেন শিখা

সাংবাদিক