ছাদেকুর রহমান ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৪:২৪
মানব সভ্যতার বিস্ময়কর বিকাশে বিজ্ঞান যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে তার অন্যতম নিদর্শন হলো মোবাইল ফোন। ১৯৭০ এর দশকে আমেরিকান বিজ্ঞানী মার্টিন কুপার মটোরোলা কোম্পানিতে চাকরি করা অবস্হায় সর্বপ্রথম এ তারবিহীন মোবাইল ফোন আবিস্কার করেন এবং এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম কথা বলেন।
তার বিহীন এবং হাতে বহনযোগ্য এ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যে বিশ্বের যেকোন প্রান্তের খবরা-খবর নেওয়া যায়।
এ মোবাইল ফোন আমাদের জীবনকে করে দিয়েছে সহজ, জীবনে এনে দিয়েছে গতি। বর্তমানে মোবাইল ফোন দ্বারা আমরা এমন কতগুলো কাজ করতে সক্ষম হয়েছি, যা আমরা কখনো কল্পনা করি নাই। এটি বহুমুখী কার্য-সম্পাদনের জন্য সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আগে যেখানে দূরে আত্মীয় স্বজন বা মানুষের সাথে কথা বলতে চিঠি লিখতে হতো এখন তা আর দরকার হয় না। এ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তোলা,ভিডিও করা ও দেখা, গান শুনা, সিনেমা দেখা,ওয়াজ শুনা, ইন্টারনেট ব্যবহার করে বেচা-কেনা, ইমেইলের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান , দেশ বিদেশের ঘটনা প্রবাহ জানা। অনলাইনের মাধ্যমে পাঠদান, অ্যাপস ব্যবহার করে শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের যেমন কল্যাণকর দিক রয়েছে তেমনি এর ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। মোবাইল ফোন তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটালেও এর অতিরিক্ত এবং অপব্যবহার চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে ছাত্র, তরুণ ও যুব সমাজকে।
দেশে মোবাইলফোন গ্রাহকের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অপ্রাপ্তবয়সী ছেলেমেয়ে,যাদের বয়স ১২-১৬ বছর।আমাদের প্রতিদিনকার বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িয়ে আছে মোবাইল ফোন। এর অপব্যবহারের কারণে এটি এখন আমাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে বিদ্যমান সমস্যাগুলো তুলে ধরা হলোঃ
শিশুর মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্তঃ একজন শিশুর মানসিক এবং শারীরিক বিকাশে ৮০/৯০% হয় শিশুর ৫ বছর বয়সের মধ্যে। এ পাঁচ বছর সময়ের মধ্য আপনি শিশুটিকে যেভাবে গড়ে তুলবেন সেভাবে গড়ে উঠবে আপনার শিশু। আপনি আপনার সময় বাঁচানোর জন্য শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছেন মোবাইল ফোন।
সে আস্তে আস্তে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে।একটা সময় আপনি দিতে চাইবেন না। তখন সে জেদ করবে এবং সে অবাধ্য আচরণ করবে। অনেক শিশু দেরিতে কথা বলে এর অন্যতম কারণ ও হচ্ছে মোবাইল ফোন। কারণ সে প্রতিনিয়ত মোবাইল নিয়ে খেলা করে। অন্য কারও সাথে মিশতে চাই না, কথা বলতে চায় না।
আবার অনেক শিশু মোবাইল ফোন ছাড়া খেতে চায় না,খাওয়ার সময় মোবাইল ফোন নিয়ে তার মনোযোগ থাকে পুরোপুরি মোবাইলের দিকে,তখন শিশু কি খাচ্ছে, কোন খাবারের স্বাদ কি রকম? সেটা বুঝতে পারে না৷ ফলে খাবার প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয় এবং শিশু শরীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। একাকিত্ব, হতাশা এগুলো খুব অল্প সময়ে শিশুর মাঝে চলে আসে।
সময়ের অপব্যবহারঃ মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে মোবাইল ফোন। ফেইসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করছে ছাত্র ও যুব সমাজ।
এক জরিপে দেখা গেছে, ছাত্ররা গড়ে প্রতিদিন ২ ঘন্টার বেশি সময় ব্যয় করছে ফেইসবুকে। এছাড়াও ইউটিউব, টিক-টক, লাইকি সময় অপচয়ের পাশাপাশি কুসংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে ছাত্র সমাজকে ।যে ছাত্ররা নিজের ক্যারিয়ার গঠনের কথা সে ছাত্র টিক-টক বানাতে ব্যস্ত।
কানে কম শোনাঃ মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মানুষ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। হেডফোন ব্যবহার করে উচ্চ শব্দে গান শুনলে অন্তঃকর্ণের কোষগুলোর উপর প্রভাব পড়ে এবং মস্তিষ্ক অস্বাভাবিক আচরণ করে। একসময় বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে।
চোখে কম দেখাঃ চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্রমাগত কমে যায় এ মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে। আজকাল ৪/৫ বছরের শিশুর চোখে চশমা অথচ যে চশমা ব্যবহার করার কথা ৩৫/৪০ বছর বয়সে।
চোখের ডাক্তার'রা বলেন স্মার্টফোন পর্দার নীলচে আলো চরম ক্ষতিকারক। স্মার্টফোন অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দীর্ঘমেয়াদি চোখের ক্ষতি হতে পারে। চোখ জ্বলা,মাথা ব্যথা, দূরদৃষ্টি কমে যাওয়ার মতো রোগগুলো মোবাইল ফোন ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত।
শরীরের অস্হি- সন্ধিগুলোর ক্ষতিঃ অতিরিক্ত সময় ধরে মেসেজ বা বার্তা টাইপ করলে আঙুলের জয়েন্ট গুলোর ব্যাথা হতে পারে এবং অবস্থা বেশি খারাপ হলে আর্থারাইটিস এর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২.৬ কোটি ব্রিটিশ নাগরিক মোবাইল ফোন অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে বুড়ো আঙ্গুলের ব্যাথায় ভুগেন।
অনৈতিক কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহারঃ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে মোবাইল ফোনের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে।অবিবাহিত যুবক যুবতীগণ তাদের পিতামাতা ও অবিভাবকদের তুচ্ছ জ্ঞান করে অবৈধ প্রেমের নেশায় মত্ত হয়ে উঠছে। অধিকন্তু বিবাহিতদের ক্ষেত্রেও মোবাইল ফোন পরকীয়ার জাল বিস্তার করছে।নিজেদের পরকীয়া দেখে ফেলায়, তা প্রচার হওয়ার ভয়ে আপন শিশুপুত্রকে খুন করে ফেলার ঘটনাও আমাদের জানা আছে।
এভাবে সর্বত্র বিভিন্ন অনৈতিক ও অসামাজিক কাজে মোবাইল ফোনের অপব্যবহার হচ্ছে। অনেকে ব্যাভিচার এবং ধর্ষণে লিপ্ত হবার পর, মোবাইলে খুব সহজে ধারণ করে, অবৈধ কার্যসিদ্ধির কাজে তা ব্যবহার করে। মিডিয়াতে আমরা প্রতিনিয়ত এরকম খবর দেখতে পাচ্ছি।
কমে যেতে পারে শুক্রানোঃ গবেষকরা জানান, মোবাইল ফোন থেকে হাই ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেড়িয়েশন নির্গত হয়। এ ক্ষতিকর তরঙ্গের সাথে মস্তিষ্কে ক্যানসারের যোগসূত্র থাকতে পারে।
গবেষকদের দাবি, মোবাইল ফোন থেকে নির্গত ক্ষতিকর জীবাণু শুক্রানোর উপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং শুক্রানোর ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে।
এছাড়াও মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের ফলে ব্লাক-মেইল, মারাত্মক দূর্ঘটনা ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে অনেকে। মোবাইল ফোন দ্বারা সহজে অশ্লীল ভিডিও দেখার মাধ্যমে ঘটছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। সমাজে দিন দিন বেড়েই চলছে বেহায়াপনা।
তাই অবিভাবকদের খেয়াল রাখা উচিত তাদের সন্তান প্রয়োজনীয় কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে কিনা? এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই মোবাইল ফোন আমাদের কাছে আর্শীবাদ হয়ে থাকবে।
লেখক:
শিক্ষার্থী
অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।